নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন—এমন অভিযোগ তিনি বারবার তুললেও, তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। তবে এবার সেই অভিযোগের স্বপক্ষে মুখ খুললেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’ বা সুপরিকল্পিত, যা শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতনের মাধ্যমে সফল হয়।
জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা এবং ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র
সম্প্রতি দেশের এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যুবকের ব্যাগ থেকে একে-৪৭ রাইফেলের গুলি উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। ঐ যুবকের সঙ্গে হিযবুত তাহরীর ও শিবির-এর দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন জানিয়েছেন, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন-এর প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, যিনি আগে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাকে নিয়োগ দেন ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
অসহযোগ আন্দোলন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সতর্কতা
গত বছরের ৪ আগস্ট সারাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ঘরে ফেরার আহ্বান জানানো হয় এবং জঙ্গি হামলার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়
“ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সকলকে নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা হচ্ছে। জঙ্গি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মেট্রোরেলে আগুন না দিলে বিপ্লব হতো না—টকশোতে বিস্ফোরক মন্তব্য
ডিবিসি নিউজ-এর ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ শীর্ষক টকশোতে অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম বলেন, যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো, তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না।”
প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত বক্তব্য এবং ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
এই মন্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। স্লোগানে তারা বলেন, “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার!”—যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরদিন ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
মাহফুজ আলমের পোস্টে সব সত্য উন্মোচিত
শুক্রবার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন,
“২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনাপর্ব ছিল ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত, যা মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। এর পর ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিপ্লব সফল হয়।”
তিনি বলেন, যখন জনগণ নেতৃত্ব ও বক্তব্য পেয়ে যাবে এবং বিপ্লবের অবজেক্টিভ কন্ডিশন প্রস্তুত, তখন আর প্ল্যানের দরকার পড়ে না। কিন্তু তার আগে জনগণকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা অপরিহার্য।”
মাহফুজ আরো বলেন, শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, এমনকি ভাসানীর মতো নেতারা যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুপরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তা প্রশংসিত হয়েছে। তাহলে আজকের প্রজন্ম ২৪-এর অভ্যুত্থান পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়ে হাসিনাকে সরালে গর্বিত হবে না কেন?”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। আর ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল বিপ্লবের বাস্তবায়ন। ২ আগস্ট রাত পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থাকলেও, অভ্যুত্থান নেতৃবৃন্দ তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন।”
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের এই পোস্টে স্পষ্ট হলো, শেখ হাসিনার বারবার অভিযোগ সঠিক ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বংশধর, জঙ্গি সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী, এবং তথাকথিত গণতন্ত্রপন্থীদের সমন্বয়ে গঠিত এক সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থানই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আজ সেই সত্যই আর অস্বীকার করার উপায় থাকল না।